রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে
গত ২ সপ্তাহ ধরে রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে পড়ছি। বইটি প্রথম পড়েছিলাম সম্ভবত ২০০০ সালের দিকে।
তখন আমার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামের মিরসরাইতে। মিরসরাই বেশ ধর্মীয় রক্ষণশীল এলাকা হলেও সেখানে প্রচুর বাংলা মদের বেচাকেনা হতো। আমি কষ্মিনকালেও বাংলা মদ খাইনি। এর প্রধান কারণ, বিকট গন্ধ। সঙ্গতকারণেই বিদেশী মদের জন্য ব্যাকুল ছিলাম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিরসরাই টিএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) সাহেবের সাথে বেশ খাতির জমে উঠল। ভদ্রলোক আপদমস্তক পড়ুয়া, নিধার্মিক ছিলেন। ঘনিষ্ঠতা হবার এটাও হয়তো একটা উপলক্ষ ছিল।
সেসময় গ্রামীণফোনের পাশাপাশি একটা সিটিসেল সিডিএমএ মোবাইল ব্যবহার করতাম। মিরসরাইতে সিটিসেল ব্যবহার করা সাশ্রয়ী ছিল। কলরেট এবং নেটওয়ার্ক দুটোই ভালো ছিল। গ্রামীণফোনে প্রতি মিনিটে গুনতে হতো ৫ টাকা ২০ পয়সা প্লাস রোমিং চার্জ। অপরদিকে সিটিসেলে আমার ফোনের প্যাকেজে রোমিং চার্জসহ রেট ছিল ২টাকা ৩০ পয়সা। যা বলছিলাম, টিএনও সাহেব রোজ একবার সিটিসেলে ফোন করেন। বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ, মদ খাওয়ার সমস্যার কথা জানালাম। একগাল হেসে জানালেন, রোজ এক বোতল বিদেশি বোতলের ব্যবস্থা করে দিবেন, কোনো টাকা পয়সা খরচ করতে হবে না। যেমন বলা তেমন কাজ। ওইদিনই আমার ডরমিটরিতে শাদা পুলিসের এক কর্মকর্তা এসে টাকিলার আস্ত বোতল দিয়ে গেলেন। এরপর থেকে রেগুলার পেতাম।
প্রবাদ আছে সিগারেট আর মদ একজনের সাথে অপরজনের বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখে। ঘটনা সত্যি। আমাদের মধ্যে দারুণ একটি সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল অল্প সময়েই। যতোদিন মিরসরাই ছিলাম, আমাকে মদ কেনার জন্য একটা টাকাও খরচ করতে হয় নি। ঘরে বসেই দামি দামি বোতল পেয়ে যেতাম।
এর কিছুদিন পরে ভদ্রলোকের ছেলের জন্মদিন পার্টিতে তাঁর বাংলোতে আমন্ত্রিত হয়ে গেলাম। মধ্যাহ্নভোজ। মিরসরাইয়ের লোকজনদের মেহমানদারি সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা আছে আগে থেকেই। কারণ জোরারগঞ্জে অনুষ্ঠিত কমবেশী প্রায় প্রতিটি বিয়ে, জন্মদিন, মুসলমানি কিংবা পুজোর অনুষ্ঠানে যাওয়া পড়তোই। সেখানে মেহমানদের পা থেকে গলা অবধি ঠেসে খাওয়ানো হতো। মানে মেহমানদের এমন কোনো আইটেম নাই যা তারা খাওয়ায় না।
টিএনওর বাংলোতেও এলাকার প্রথা অনুসরণ করে সেইরকম জাকজমক খাবার আয়োজন। ভোজনরসিক হলেও পাবলিক প্লেসে তেমন খেতে পারিনা। ওইসময় টিএনওর ড্রয়িংরুমে আবিস্কার করি নানান রকমের বইপত্র। থরে থরে বই, ঘরের এখানে সেখানে বই। সেখানেই পাই ভারতের দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’ বইটি। এতো বই ছেড়ে এই বইটি আমাকে টানার পেছনেও গল্প আছে। দৈনিক ইত্তেফাকে ‘লুব্ধক’ ছদ্মনামে কেউ একজন কলাম লিখতেন। সেখানে রাজনৈতিক প্রবন্ধের একটা অনুচ্ছেদে ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর নাম পড়েছিলাম ৮৯/৯০ সালের দিকে।
টিএনও সবদিক দিয়ে উদার হলেও বই ধার দেয়ার বেলায় উদার ছিলেন না। কী মনে করে বইটি আমাকে দিলেন এক শর্তে, ৩ দিনের মধ্যে বইটি ফেরৎ দিতে হবে। নতুবা মদ সাপ্লাই বন্ধ। আমি অবশ্য একদিন পরেই বইটি ফেরৎ দিয়েছিলাম। পরদিন অফিসের ফটোকপি মেশিনে পুরো বইটি ফটোকপি করিয়ে নিয়েছিলাম, আমার কালেকশনে রাখা ও পড়ার জন্য।
এরপর ২০০৪ সালে পাবনায় চাকরির সময় শহরের অন্নদা গোবিন্দ লাইব্রেরিতে এই বইটির ঝকঝকে কপি পাই। প্রথম সুযোগেই বইটি আমি মেরে দিই। মেরে দিই বলতে বইটি ধারে নিয়ে এসে মিথ্যে বলি যে বইটি হারিয়ে গেছে। বইয়ের মূল্য বাবদ এবং সার্ভিস চার্জ বাবদ যা দাম হয় অর্থাৎ বাংলাদেশী ৪শ টাকা পরিশোধ করি। বইটা আমার বাড়িতে নিরাপদেই ছিল। কিন্তু একটা কথা প্রচলিত আছে- চোরের ওপর বাটপারি। আমার সাথেও একই ঘটনা ঘটেছিল। অধ্যাপক কমরেড নুরুন্নবি ও কমরেড টিপু বিশ্বাসসহ কয়েকজন আমাদের বাড়িতে একটা মিটিং এর জন্য একবেলা ছিলেন। এঁরা চলে যাবার পরে আমার সেলফ থেকে কয়েকটা বই লাপাত্তা হয়ে গেছিল। তারমধ্যে এই বইটিও ছিল। এরপর থেকে কমিউনিস্ট লোকজনদের থেকে আমি সাবধানে থাকি।
২০১০ সালে আমার বাচ্চাদের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়েছিলাম। টানা দেড়মাস ছিলাম। উঠেছিলাম রাফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের এনাম গেস্ট হাউসে। মেয়ের চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার আগে একদিন বাচ্চাদের হোটেলে রেখে ছুট লাগালাম কলেজ স্ট্রিট। দে’জ এর শোরুমে লাইনে দাঁড়িয়ে কিনলাম কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’ বইটি। এরপর ২০১৩ সাল থেকে দেশে নানান ঝামেলা ও পালিয়ে বেড়ানোসহ অনেক ঘটনা ঘটে গেল। বইটির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।
২০১৬ সাল,আমি জার্মানিতে। ডিসেম্বরের দিকে, অর্পিতা রায়চৌধুরী কলকাতায় আত্মগোপনে। তাকে ফোন করে বললাম, পরদিন কলেজ স্ট্রিট গিয়ে বইটি কিনে আমাকে নিউমার্কেট পোস্ট অফিস থেকে পার্শ্বেল করে পাঠাও। এর পনেরো-কুড়িদিন পরে বার্লিনে বসেই বইটি পেয়ে যাই। গত দুই সপ্তাহ যাবৎ বইটি পড়তে গিয়ে বারবার পুরাতন স্মৃতিগুলো গোলমাল পাকাচ্ছে।
ভেবেছিলাম বইটির প্রকাশনা সংস্থায় চিঠি লিখে জানাবো, বইয়ের টাইপ সেটিংস বদল করতে। কারণ এতো ছোট ফন্টে, এতো ঘন স্পেসিং এ ছাপা বই এই বয়সে পড়া কষ্টকর। চশমা পড়েও পড়া আরামদায়ক নয় মোটেই। ৩৪৬ পৃষ্ঠার জায়গায় বইটা ৫শ বা ৬শ পৃষ্ঠা হলে কী এমন ক্ষতি হতো? না হয় ৫০ রুপি দাম বাড়তো!
ছয়শো টাকা এমন কিছুই না। কারণ কেতকী কুশারী ডাইসনের এই বইটি যেন বহমান এক নদী। ‘সৃষ্টি ও অন্বেষণ’ এমন দ্বৈত স্বাদের অন্য কোনো বইয়ের খোঁজ খুব কমই জানা আছে আমার। ভিকতোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অনেকেই অনুবাদ ও বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে টুকলি করে বই লিখেছে বটে, কিন্তু সেগুলো সুপাঠ্য তো নয়ই, শতভাগ সঠিকও নয়। কেতকীর বইটি এমন এক বই যা বার বার পড়েও কেমন যেন না পড়ার চিনচিনে অনুভূতি রয়ে যায়।
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ