মনকথা
খুবই বিতর্কিত পোস্ট কেমন! এমনকি আমার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। সে ওঠে উঠুক তাতে অসুবিধা নেই কিন্তু মুশকিল হলো যে বিষয়টা খুব সহজ হলেও অন্তর্নিহিত অর্থ বড় জটিল। ড্রয়িং ক্লাসে আমাদের স্যার বলতেন যে ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং করার প্রথম শর্তই হচ্ছে যে কান ধরে টানলে, মাথা আসবে। এই বিষয়টার তো অনেকগুলো মাথা তাই আলোচনা করতে করতে একটা মাথা থেকে আরেকটা মাথায় পৌছে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না।
অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম যে এই বিষয়টা নিয়ে লিখবো। কিন্তু এর জন্য কিছু রিসার্চ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। থিওরিটিক্যাল রিসার্চ নয় প্র্যাকটিকাল রিসার্চ। গত তিন/চার বছর ধরে ডেটা কালেক্ট করার করলেও এই বিষয়টা নিয়ে লেখার সময় পাচ্ছিলাম না। গতকাল এক বন্ধু, খুব জোরে একটা ঠেলা মারলো। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে তার একটি বাচ্চা মেয়ে আছে। আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝেই আলোচনা হয় যে বাচ্চাকে কীভাবে বড় করা উচিৎ। আজকের প্রধাণ বিষয় এইটাই। তো সেই বন্ধুর উত্তরে তাকে যে কথাটা বললাম সেটা আগে লিখছি – “ আমার বাচ্চা নেই বলে অনেক কথা শুনতে হয় আর তুই আমাকে এটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখার কথা বলছিস?” সে গালি দিলো ঠিকই কিন্তু এটা সত্যিই একটা ইস্যু আর এখন যেহেতু সবাই বাড়িতে আছে তাই রিসার্চগুলো তুলে ধরার হয়ত এইটাই মোক্ষম সময়।
কান ধরে টানলাম-
একটু অন্যদিক দিয়ে আলোচনাটা শুরু করি। যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার দরূন এবং প্রতিবেশীদের সাথে মেলামেশা করে, ছোটোবেলা থেকেই কিছু কিছু বিষয় চোখে পড়েছিল। অনেক বিষয়ই তখন অত তলিয়ে ভাবি নি বা ভাবলেও সেটা যে ব্যক্ত-ও করতে হয় সেটা জানতাম না তাই নিজের ভাবনা দিয়ে ডায়রির পাতা ভরাতাম। বড় হওয়ার সাথে সাথে কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা জন্মাতে শুরু করলো। বাবা-মায়ের বড় সন্তান অর্থাৎ দিদিভাই, আমার জন্মের আগেই মারা যান। এই অকালমৃত্যুর দুঃখকে, প্রতিটা পদে সমাজ কী ভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে সেটা ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি। যে কোনো শুভ কাজে মায়ের যাওয়া বারণ ছিল। প্রায় প্রত্যেকটা শুভ কাজের আগে মাকে কাঁদতে দেখতাম। তখন খুব কান্না পেতো মায়ের দুঃখে কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে দুঃখটুঃখ উড়ে গিয়ে রাগ জমা হতে শুরু করলো। এমনকি মায়ের রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর আঘাতে মাকে জর্জরিত হতে দেখেছি প্রতিনিয়ত আর বাবাকে দেখেছি সেই সময় মাকে আগলে রাখতে। তারপর জানতে পারি যে এটা শুধু আমার মায়ের সাথে নয় আমার আরেকমাসির সাথেও একই ঘটনা ঘটে চলেছিল। সমাজের চাপে একপ্রকার বাধ্য হয়ে মা এবং সেই মাসি নিজেকে অপয়া ভাবতে শুরু করেন।

আমার বিয়ের কিছু আগে এক মেসো মারা যান। সেই মাসি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে যখন বললেন -“ মৌ তোর বিয়েতে কত আনন্দ করবো ভেবেছিলাম কিন্তু আমার আর যাওয়া হোলো না।“ তাঁকে বলেছিলাম যে তুমি না এলে আমি বিয়ের পিড়িতে বসবো না। কখনও না কখনও সমাজের এই দূরাচারকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে হয়। বিয়েতে বসার আগে বড়মাসিকে দেখে তবে পিড়িতে বসেছিলাম। অনি বলেছিল যে মামনি মানে আমার মাকেই বিয়েতে যাবতীয় কাজ করতে হবে, কোনো কাজে পিছিয়ে আসা যাবে না। বলাই বাহুল্য যে আমার বিয়েতে এই ধরণের কোনো নিয়মই মানা হয় নি। আপনারা বলবেন ধুর এখনও এইসব হয় না কি। আমি বলবো- নিজেকে দিয়ে সবকিছু বিচার না করে চারপাশটা তাকান। কুয়োর ব্যঙের জ্ঞানকে অন্ধকারের সাথে তুলনা করা হয় – সেটা জানা আছে নিশ্চই।
বাস্তবে নিজের মেয়ে আর অন্যের মেয়ের মধ্যে পার্থক্য না করলেও সমাজ কিন্তু অন্য কথা বলে। আমার বিয়ের কিছু বছর বাদে আরেক বোনের বিয়ে হয়। মাকে সামনে বসিয়ে তিনজন, খুব কাছের মানুষ, চিনি মিশিয়ে অপমান করলেন। সেই বোন যাকে বাবা-মা নিজের সন্তান মনে করে, সেই বোন যার জন্য আমরা ছোটোবেলা থেকেই দুইবোন থেকে তিনবোনে পরিণত হয়েছিলাম, সেই বোন যার সাথে মায়ের বানানো তিনটে একধরনের জামা পরে আমরা ঠাকুর দেখতে বেরোতাম, সেই বোন যাকে বাবা ভাত খাইয়ে দিত – তার বিয়ের শুভ কাজে মা থাকতে পারবেন না। সেই প্রথম, আমার বোন সবার সামনে প্রতিবাদ করার সুযোগ পায়। আমি তখন মুম্বাইতে। মাকে বলেছিলাম বিয়েতে কেউ যাবো না। মা শোনেন নি, আর কেউ না বুঝলেও বাবা-মা তো তাকে মধ্যম সন্তান মনে করে সেই সন্তানের বিয়েতে যাবে না! অনি আর বোন বেঁকে বসলো। তারা যাবে না। অগত্যা বাবামাকে একা ছাড়বো না তাই আমি গেলাম বাবামায়ের সাথে। ঠিক করেছিলাম যে বিয়েবাড়ি হোক আর যাইহোক, এইবার কেউ অপমান করলে ছেড়ে কথা বলবো না। আর বিয়ের পরে কারুর সাথে সম্পর্ক রাখবো কি না সেটাও ভেবে দেখবো। অনেকদিন সম্পর্ক রাখিও নি কিন্তু মায়ের আপনজন তাই সম্পর্ক না রাখলে মায়ের খারাপ লাগে আর সবার বয়স হচ্ছে এবং সর্বোপরি ক্ষমা করতেও জানতে হয় কিন্তু ভুলে যেতে নেই।
এতোগুলো কথা বলার কারণটা এবার বলি। সন্তান না হলে না কি নারী হওয়া সম্পূর্ণ হয় না। অথচ গর্ভে ধারণ করার পরে সেই সন্তান চলে গেলে তাকে অপয়া বলা হয়। এই সমাজকে আপনারা মানতেই পারেন কিন্তু আমি মানি না। কথায় বলে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। এই ক্ষেত্রে কথাটা প্রতি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
এইবার আসি আরেকটা মাথায় :-
এইবার আসি যাদের বাচ্চা নেই তাদের কথায় অর্থাৎ আমার কথায়। এইবার একটু গবেষণার কথা বলি। যাদের বাচ্চা আছে তাদের মানসিকতাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।
১. খুব পরিকল্পনা করে বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল।
২. আমরা না চাইনি কিন্তু হয়ে গেছে। তাই ভাবছি যা রাখবো না কি…(পরের কথাটা কলম দিয়ে বেরোলো না)
৩. বাচ্চা আসছে শুনে খুব খুশি কিন্তু আগাম ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিন্তিত।
৪. যারা স্বেচ্ছায় বাচ্চা নেয় নি বা নেবে না।
প্রথম এবং তৃতীয় ব্যক্তিদের নিয়ে কিছু বলার নেই কারণ একটা জীবনকে সঠিক ভাবে লালনপালন করে বড় করে তোলা অবশ্যই একটা বিশাল দায়িত্ব। সেটা নিয়ে চিন্তান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
এইবার আসি দ্বিতীয় গোষ্ঠীর দিকে। চাইনি কিন্তু হয়ে গেছে মানেটা কী? বাচ্চা না চাইলে অনেক অপশান আছে। কন্ডোম ব্যবহার করাটাই যদিও ঠিক কিন্তু উত্তেজনার মুহূর্তে সেটা ভুলে গেলেও, পিল তো আছে রে বাবা (একটু এড করি, ভেবেছিলাম যে ওটা অন্য বিষয় কিন্তু রিমি-র কথাটাই ঠিক। যতোটা সম্ভব পিল এভয়েড করবেন। খুব ছোটো করে বলতে গেলে বলা ভালো যে পিলের অত্যাধিক ব্যবহারে ডিপ্রেশান হয় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই কন্ডোম ব্যবহার করাই সেফ নতুবা ডাক্তারের পরামর্শ করে ওষুধ খাবেন)। যে সন্তানের আসার খবর শুনে প্রথমেই আফসোস হয় এবং তাকে রাখবে কি রাখবে না সেই চিন্তা করতে হয় তাহলে সেই সন্তানের বাবা-মা হওয়ার যোগ্যতা তারা প্রথমেই হারিয়ে ফেলে।
চতুর্থ গোষ্ঠী অর্থাৎ এখানে “আমরা”। আমরা বেবি নেবো না কিন্তু অসাবধানতা বশত যদি বেবি চলে আসে তাহলে তাকে সাগ্রহে ধরে রাখবো আমার গর্ভে। আমাদের মতো মানুষদের কিন্তু অনেক কথা শুনতে হয়। কিছু কিছু লাইন তুলে ধরে বিষয়টাকে একটু বোঝাবার চেষ্টা করি।
বিয়ের কিছুদিন বাদে বেবি নেওয়াটা অনেকটা খাওয়ার পরে বাসন মাজার মতো অন্তত অধিকাংশ মানুষ সেটাই ভাবেন। আপনি তো ভেবেই রেখেছেন যে বেবি নেবেন না এইবার উড়ে আসা বক্তব্য হলো
১. এমা!! এটা আবার কেমন কথা! বিয়ে হয়েছে অথচ বেবি নেবে না! – বোঝো…সিঁদুরের সাথে বাচ্চা নাকি ডিফল্টে চলে আসে।
২. অ…সারাজীবন ফুর্তি–ই করতে পারো কিন্তু বাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব নিতে পারবে না – রিয়েলি! মানে বাচ্চা নিলে ফুর্তি করা যায় না! অর্থাৎ বাচ্চা নেওয়ার পর আপনার জীবন থেকে সব আনন্দ চলে গেছে! অর্থাৎ বাচ্চা নিয়ে আপনি হিমশিম খাচ্ছেন অথচ অন্যকে বলছেন যে বাচ্চা নাও! আপনাদের দেয় কে?
৩. যে টাকাটা ওড়াচ্ছিস সেটা নিয়ে বাচ্চা মানুষ কর তাহলে বুড়ো বয়সে দেখার লোক থাকবে – তারমানে বাচ্চা নেওয়াটা একটা ইনভেস্টমেন্ট? কোনো কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে বাচ্চা নিয়েছেন? অর্থাৎ আপনার ইচ্ছায় আপনার বাচ্চা পৃথিবীতে আসার পর আপনি তাকে লিখিয়ে পড়িয়ে বড় করে চাকরি করতে পাঠিয়েছেন কিন্তু পেছন থেকে দড়িটা টেনে রেখেছেন!
একটা সহজ কথা বলি অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়- যে সন্তান খুব খোলামেলা ভাবে বড় হয়েছে তারা কিন্তু বাবামাকে কোনোদিন ছেড়ে যায় না। বুড়ো বয়সে বাচ্চা আপনাকে এমনিই দেখবে যদি আপনার সাথে আপনার বাচ্চার ভালো সংযোগ থাকে। কিন্তু প্রথমেই যদি স্বার্থ নিয়ে বাচ্চাদের বড় করে তোলেন তাহলে সেই সন্তান অন্য কোনো স্বার্থে আপনাকে ছেড়ে যাবে না তার কোনো গ্যারান্টি আছে কি?
নেই। মাটির তালকে ছোটোবেলা থেকে যেভাবে বড় করবেন আপনার বাচ্চা ঠিক সেই ভাবে বড় হবে। ভালো পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা কোনো স্ত্রী কখনই তার স্বামীকে বলবে না যে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসো বা ভালো পরিবেশে বড় হওয়া কোনো ছেলেকে যদি তার স্ত্রী বলে যে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসো তাহলে সে দৃঢ় স্বরে তার প্রতিবাদ করবেই।
এইবার কথা উঠবে যে ভাল পরিবেশ কাকে বলে। এটার দায় কিন্তু সম্পূর্ণ আপনার। তার আগে একটা কথা বলে নিই যে “যার বাচ্চা নেই তার কাছ থেকে জ্ঞান শুনতে হবে?” এটা যদি আপনার বক্তব্য হয় তাহলে বলবো যে আপনারা হিপোক্রিট। হ্যাঁ আমার বেবি নেই কিন্তু এটা বুঝি যে আশেপাশের বাচ্চাগুলোকে যেভাবে বড় হতে দেখছি তাতে একটা জিনিস বলতে পারি যে আমাদের বাচ্চা না থাকলেও আমরা অনেকের থেকেই অনেক ভাল বাবা-মা হওয়ার যোগ্যতা রাখি।
কিছুদিন আগের কথা, আমাদের একতলার দুটো ফ্ল্যাটে তখন একদিকে একটা বাচ্চা মেয়ে সে kidzee তে পড়ছিল আর পাশে ফ্ল্যাটের একটা বাচ্চা ছেলে তার বয়স তখন চার কি সাড়ে চার। সামার ভ্যাকেশান চলছে…আমি নিচে নামছি, বাজারে যাবো। বাচ্চা মেয়েটার ফ্ল্যাটের দরজার খোলা ছিল। আমার আওয়াজ পেয়ে সে দরজার কাছে এসে বলল “ তাতি তাতি…তোমার ভৌ ভৌ তি তরছে?” তার হাতটা ধরে বললাম “ মাম্মা, ওরা সকাল থেকে দুত্তুমি করে এখন ঘুমু ঘুমু করছে। তুমি কি খেলু খেলু করছ?” পাশ থেকে তার মা বেশ বিরক্তি সহকারে বলল “ সারাদিন দুষ্টুমি করেই চলেছে। কেন যে স্কুলে ছুটি দেয় বুঝি না বাবা। কী জ্বালান যে জ্বালাচ্ছে বলার কথা না।“ মেয়েটি তখন কোমরে হাত দিয়ে মায়ের দিকে চোখ ঘুরিয়ে আরও বিরক্তিতে বলল “উফফফ…তালি এত (এক) ততা, তালি এত ততা। তুমি কুলে দাও আমি পুতু খেলব।“ আড়াই তিনবছর বয়সের বাচ্চা মেয়ে, যার কি না এখন স্কুলে যাওয়ার কথাই নয়, সে মায়ের কথার প্রতিবাদ করছে। সে বুঝতে পারছে যে তার মা ঠিক কথা বলছে না। কিছুদিন বাদে বাজার করে ফেরার পথে ওর মায়ের সাথে দেখা হয়েছে , তখনকার বক্তব্য “ বাবাহ.. যেন স্কুলটা খোলার পর যে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এই সময়টাই একটু আরাম করা যায়। না হলে সারাদিন যা জ্বালায়।“ মনে মনে মাথায় হাত। এই বাচ্চা ছোট থেকেই বুঝতে পারছে যে তার মা তাকে বাড়িতে চায় না। বাচ্চাদের সেন্স কিন্তু প্রবল, তারা বোঝে সবই। অনেক সময় অবচেতন মনে রয়েও যায় কথাগুলো। তাহলে আপনার মনে হয় যে এই বাচ্চা বড় হলে আপনার কথা শুনে চলবে। বাচ্চার দুষ্টুমি যদি মেনেই না নিতে পারেন তাহলে বাচ্চা নিয়েছেন কেন? বাচ্চা কি পুতুল? তারা দুষ্টুমি করবে না তো কি আপনারা করবেন? তাহলে বাচ্চা নেওয়াটা আপনাদের কাছে নিয়ম না দায়বদ্ধতা? কোনটা?
আমার এক দাদা একবার কিডজির ফ্যাঞ্চাইজি নিয়ে ছিল। বৌদি দেখাশোনা করত। তাদের অভিজ্ঞতা বলে যে kidze –র এতো রমরমার কারণটাই হলো যে অধিকাংশ বাচ্চা যাদের বয়স ২ থেকে ৪-এর মধ্যে, তারাই এখানে আসে কারণ হয় তাদের বাবামায়েরা ব্যস্ত অথবা কিছুক্ষণের জন্য বাচ্চাকে এখানে পাঠিয়ে তারা মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। এইসব বাবামায়েদের কাছে একটা প্রশ্ন রাখি- এরপরেও আপনারা আশা করেন যে এই বাচ্চারা বয়সকালে আপনাদের দেখবে! এতো এক্সপেক্টশান আসে কোথা থেকে আপনাদের? ওপরের কথাটাই আরও একবার রিপিট করলাম- নিয়ম না দায়বদ্ধতা?
কিছুদিন আগে আমার ফ্ল্যাটের থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অন্য একটি বিল্ডিং-এ, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের জেরে পুলিশ এসেছিল। পুলিশের গাড়ি আমার ফ্ল্যাটের সামনে দিয়েই গেছে, লোকে লোকে ছয়লাপ হয়ে গেছিল কিন্তু আমি এতোটাই ট্যালা যে কিছুই শুনি নি। সেদিন আবার অনি বাড়ি আসবে তাই সুপারডুপার ব্যস্ত ছিলাম। অনি বাড়িতে ঢোকার পরপর পাড়ার একটি ভাই ফোন করে অনিকে ঘটনাটা জানায়। সেই ভাই জানতো না যে অনি আসবে কিন্তু পাশাপাশি ফ্ল্যাট হওয়ার জন্য পুলিশ হয়তো আমাকেও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে তাই অনিকে ফোন করার উদ্দেশ্য ছিল যাতে অনি আমাকে প্রিপেয়ারড করে দেয়। আমাকে পুলিশের কথা জানালে আমি যদি টেনশানে পড়ে যাই তাই সে দাদার হেল্প নিয়েছিল। অনি ফোনটা রেখে, এই বিষয় যখন জানতে চায় আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলি “ তাই বুঝি!! জানি না তো!” অর্থাৎ আমি এতোটাই সব ব্যাপারে উদাসীন যে ঘাড় ঘরে না দেখালে, প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে কিছুই আমার অগোচরে আসে না। কিন্তু একতলার বাচ্চা ছেলেটির বাড়ির পরিবেশ এতটাই খারাপ যে রাত দেড়টার সময় তাদের ঝগড়ার জন্য এক একদিন ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাড়ির দুই সদস্যই বেশ লেভেলের মানুষ। পুরুষটি, বুকের দিকে ছাড়া তাকাতে জানে না আর মহিলা আমাকে পচ্ছন্দ করে না। বাচ্চাটার সাথে দুবার কথা বলতে গিয়ে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল যে কেউ নিমপাতা গিলিয়ে দিয়েছে।
লোকাল মিডিয়া অর্থাৎ আগের পরিচারিকা একদিন আমাকে জানায় যে একা মেয়ে মানুষ, বাচ্চাকাচ্চা নেই, স্বামী এখানে থাকে না তাই আমার বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে সে কী কী ফেস করেছে সেটা তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। পরিচারিকার কথায় গুরুত্ব না দিলেও মহিলার কাজকর্মে মনে হোতো যে আমার সম্ভন্ধে খুব একটা উচ্চবিচার সে রাখে না। মুখের সামনে, আধ ভেজানো দরজা, জোরে বন্ধ করে দেওয়া বা নিচে আমাকে দেখলে ফোনে বেশ জোরে জোরে “ আরে বুঝিস না একা মহিলা মানেই নোংরা চরিত্র।“ অবশ্য মহিলার জন্য আমার একটু মায়াই হয় কারণ যার স্বামী অম্য মেয়েদের বুকের দিকে ছাড়া তাকাতে পারে না তাদের স্ত্রীরা এইভাবেই নিজেদের এন্টারটেইন করতে ভালবাসে। কিন্তু কষ্ট হয় বাচ্চা ছেলেটার কথা ভেবে। দুজনের মধ্যে পরিত্রাহি ঝগড়া এবং গালাগালির পরে যখন বাচ্চাটার কান্না ভেসে আসে। খুব মায়া হয়। এই বাচ্চা মানুষ হওয়ার আশা কতটা?
এইবার কিছু কিছু পরিবর্তন হওয়া শুরু হলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলে খোলা দরজা, দড়াম করে বন্ধ করার পরিবর্তে সেখান দিয়ে হাসিমুখ উঁকি মারা শুরু হলো। আমিও হেসে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতাম। তার বাচ্চার জন্মদিনে আমাকে নিমন্ত্রণ-ও করলো। চক্ষুলজ্জা না অন্য কারণ সেটা জানি না। অস্বীকার করবো না যে একরাশ কচি কচি বাচ্চাদের মাঝে বসে বেশ নার্ভাস লাগছিল। তাদের বুদ্ধি, তাদের কথা সবকিছুই আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করার মতো যে প্রতিটা বাচ্চাই আলাদা আলাদা খেলা নিয়ে একা একা খেলে চলেছে। একটি বাচ্চা অন্য একটি বাচ্চার খেলা নিলেই সেই বাচ্চাটি ক্ষেপে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করছে। অবাক হওয়া সবে শুরু। প্রত্যেক মা আমি রিপিট করছি প্রত্যেক মা তাদের বাচ্চাকে শেখাচ্ছে যে দুজনে পাল্টাপাল্টি করে কিছুক্ষণ খেলো তারপর আবার পুরোনো খেলনাটা ফেরত পেলে সেটা নিয়ে খেলবে। একজন মাকেও বলতে শুনলাম না যে “ একসাথে একটা খেলা নিয়ে খেলো “ বা “ পাশাপাশি বসে ভাগাভাগি করে খেলো।“
আপনাদের মনে হয় যে এই বাচ্চাগুলো শেয়ারিং কাকে বলে সেটা জানে! কেন জানে না? কারণ আপনি শেখান নি। আপনি শেখান নি যে একটা পুতুল নিয়ে অনেকে মিলে খেলা যায়। আপনি শেখান নি , একটা বাজনা অনেকে মিলে বাজানো যায়। আপনি শেখানি নি, ভাগ করলে আনন্দ বাড়ে বৈ কমে না। বড় হয়ে আপনার বাচ্চা যদি বলে যে তার ২৪ ঘন্টার সময়ের ভাগ সে আপনাকে দিতে পারবে না তখন আপনি কী করবেন? হাত কামড়ে লাভ নেই…আপনার বাচ্চা সেই ভাবেই বড় হয়েছে ঠিক যে ভাবে আপনি চেয়েছেন।
বইমেলার পরে, ঐ হাসির কারণটা জানতে পারলাম। তার ছেলে বায়না ধরেছে যে তার আঁকা ছাপতে হবে তাই আমি যদি কোনো ব্যবস্থা করে দিই।
“ তুমিও তো মা, তাই তুমিই বুঝবে। বাচ্চাদের আব্দার তো রাখতেই হয় বলো। খুব বায়না করছে গো…দেখো না যদি কিছু করা যায়।“
বাবার কাছে একটা চকোলেট চাইলে বাবা সেটা এতদিন বাদে দিতেন যে চকোলেট যে চেয়েছিলাম সেটাই ভুলে যেতাম। এতে যেটা হোতো যে ঐ চকোলেটের গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে তো যেতোই আর আনন্দটা হতো মাত্রাছাড়া। ঐ একটা চকোলেট সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়ার মজাই আলাদা ছিল।
বাচ্চারা আব্দার করবেই কিন্তু আব্দার করার সাথে সাথে সেটা মেটাতে হবে! এইটুকু বোঝেন না যে এতে বাচ্চাদের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। একজন পাঁচ বছরের বাচ্চা যে না কি সবে একবছর আঁকা শিখেছে। সে আব্দার করেছে বলেই তার আঁকা ছাপানোর জন্য আপনার এতো ভণিতা! এতো হাসি এমন কী জন্মদিনে ডেকে পর্যন্ত ফেললো! সব স্বার্থ। কারণ আমি যখন বললাম যে এই ধরণের কোনো খবর আমার কাছে নেই দরকার হলে আনন্দবাজারে রবিবাসিরীয়তে বাচ্চাদের ছবি ছাপা হয় সেখানে যোগাযোগ করতে পারো, সেটা শোনার পর থেকে আবার দরজা দড়াম। এককথায় বলতে গেলে বাচ্চাটির অত্যাধিক চাহিদা এবং বাবামায়ের স্বার্থপরতায় বাচ্চাটি যে বড় হয়ে কী হবে সেটাই দেখার।
কিছুদিন আগে একটা পোস্ট দেখেছিলাম যে সবুজ রঙের একটা খেলনা যেটা অনেকটা করোনা ভাইরাসের মতো দেখতে। দুদিন বাদে এক বন্ধু একটা ছবি পাঠায় যেখানে সে বলে ঐ খেলনাটা তার বাচ্চার ছিল, সে বাচ্চাকে বলেছে যে এটা করোনা একে মেরে ফেলো। তাই বাচ্চাটি সেই খেলনাটি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে বলেছে “ বাবা দেতো তরনা ময়ে গেছে।” খেলতে খেলতে কোনো জিনিস ভেঙে ফেলা আর চাপিয়ে দেওয়া নৃশংসতার মধ্যে পার্থক্য আছে। বাচ্চাদের হিংসাত্মক মনোবৃত্তি বৃদ্ধি করাটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ বলে আপনার মনে হয়? মেরে ফেলা, গুলি করা এইগুলোতে বাচ্চাদের মানসিকতার কী ধরণের এফেক্ট পড়ে সেটা খবরের কাগজ খুললে আপনারা দেখতে পান না? আপনি বলতেই পারেন যে আমি বেশি রিয়্যাক্ট করছি কিন্তু অপরাধী তো আমাদের পেট থেকে জন্মায়, তারা তো আর আকাশ থেকে পড়ে না।
আপনাদের শিক্ষার প্রতিফলন পুরোটাই দেখতে পাবেন যখন আপনার বাচ্চা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকবে। বাচ্চা মেয়েটি হয়তো ধরেই নেবে যে সে তার মায়ের কাছে একটা বার্ডেন। ছোটো ছেলেটি প্রথম থেকেই দেখে আসছে যে তার বাবা দুশ্চরিত্র, বাবা-মা ঝগড়া করে, সে যা চাহিদা করে সেটা মেটানোর জন্য বাবা-মা অনেকদূর পর্যন্ত যেতে পারে। ফলস্বরূপ বাচ্চাটি একাকীত্বে ভুগতে থাকবে, জেদি তৈরি হবে এবং কাউকে সম্মান করতে পারবে না। এবং জন্মদিনে আসা সেই বাচ্চাগুলো কোনোদিনই “আমাদের” বলতে শিখবে না।
সন্তান না নিলেও, পরিবারের বাচ্চারা আমার সন্তান। এইসব অবহেলিত, কুশিক্ষায় বড় হওয়া বাচ্চাগুলোকে দেখলে খুব ভয় হয়। এরাই তো সমাজের ভবিষ্যৎ, এরাই তো সমাজের মাথা হবে একদিন। কিন্তু এমন শিক্ষা কি তাদের মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে পারবে?
এই সময়টাকে কাজে লাগান। সন্তানকে উপযুক্ত মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে গেলে আগে নিজেরা ভালো বাবা-মা হোন। কোথায় হ্যাঁ বলতে হবে, কোথায় শাসন করতে হবে। কোন চাহিদা মেটাবেন, কী ধরণের মানসিকতায় বড় করে তুলবেন বাচ্চাদের একবার ভাবুন প্লিজ।
নাহলে নিচের চিঠিটার মতো আপনাকেও আপনার বাচ্চা একসময় বাজে বাবা-মা বলবে। সেই দুঃখ সামলাতে পারবেন তো?
–কলকাতা, ভারত
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ