বোকা নাগরিক
আমরা যে রাষ্ট্রে জন্মেছি, সেখানে একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রকে নিঃস্বার্থভাবে আমৃত্যু শুধু সঁপেই যেতে হয়। বিষয়টা বড্ড বেশি একপাক্ষিক জেনেও আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। যদিও আপাত দৃষ্টিতে এই ব্যাপারটাকে নিষ্কাম দেশপ্রেম ভেবে অনেকেই বিভ্রান্তিতে ভোগেন। এখানকার সিস্টেম মহাজাগতিক ব্ল্যাকহোলগুলোর মতো। কোন প্রকার শক্তি বা পদার্থ ব্ল্যাকহোলের আবেশে জড়ালে তা চিরকালের জন্য ব্ল্যাকহোলে বিলীন হয়ে যায়। সেই শক্তি বা পদার্থের শতকরা পৌনঃপুনিক এক ভাগও ব্ল্যাকহোল থেকে ফেরত আসেনা কখনও। রুপান্তর ঘটার সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দিয়ে সেগুলি সম্পূর্ণভাবে শোষন করে নেয় ব্ল্যাকহোল। বাংলাদেশ নাগরিক অধিকার-কর্তব্যের বেলায় পদার্থবিজ্ঞানের ব্ল্যাকহোলের নীতি মেনে চলে। একজন নাগরিক আজীবন রাষ্ট্রকে শুধু উজাড় করে সঁপে যান সব, নিজের প্রাপ্তির ভাগকে ত্যাজ্য জ্ঞান করে । ‘ত্যাজ্য জ্ঞান’ শব্দগুচ্ছ এখানে ব্যবহার করা কতোটা সমীচীন হলো বুঝতে পারছিনা। কারণ আশাকে একজন ব্যক্তি তখনই ত্যাগ করতে পারেন, যখন তিনি বুঝতে পারেন যে তার আশা করার কোন কারণ ছিলো বা আশা করার অধিকার রয়েছে। দুর্ভাগ্য হলেও তেতো সত্য এটাই যে, বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ এটাই জানেননা যে তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যুনতম কিছু আশা করার অধিকারও রাখেন। তারা এটাও বোঝেননা যে, রাষ্ট্রযন্ত্র মানে সরকার বা সরকারী কর্মচারী নয়। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের অর্থ তারা নিজেরাই। এদেশের পারিবারিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার হাল এতোটাই শোচনীয় যে (হয়তো উদ্দেশ্যমূলক ভাবে শোচনীয় করে রাখা হয়েছে এবং ধীরে ধীরে তা স্থায়ী পঙ্গুত্বের পথে নেওয়া হচ্ছে) স্নাতকোত্তর সনদপত্র হাসিল করার পরেও বিশুদ্ধ দেশপ্রেম, দেশের প্রতি বিশুদ্ধ কর্তব্য এবং দেশ থেকে প্রাপ্য অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো সঠিকভাবে বুঝে ওঠার মতো অথবা বোঝার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হবার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাত্রছাত্রীদের ভেতর পরিলক্ষিত হয়না(হয়তো সুচতুরভাবে তাদেরকে সেই জ্ঞান অর্জন করতে দেওয়া হয়না)। সঠিক দেশপ্রেমের স্বাদ বুঝতে না পারায় একজন নাগরিক অপরজনকে যথেষ্ট পরিমাণে ভালোবাসতে বা উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করতে ব্যার্থ হন। ফলশ্রুতিতে সমাজে পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, ঘৃণাবাদ ও হিংস্রতার মতো নানাবিধ ভাইরাস জন্ম নেয়। লোকজন একে-অন্যকে নিজের চেয়ে ছোট অবস্থানে দেখে এক ধরনের পৈশাচিক ফুর্তি পাওয়া শুরু করেন। অবচেতন মন থেকেই এর সূত্রপাত হয়। নাগরিকের মনস্তত্ত্বে বর্নবাদের পাশাপাশি অদ্ভুত রকমের এক শ্রেণীবিন্যাস গড়ে ওঠে, বড়-ছোট চর্চার। তারা পেশা ও পুজিবাদি সম্পদের ভিত্তিতে নাগরিকের সামাজিক মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাসমূহের কম-বেশ করার প্রয়াস পান (যদিও তা করার অধিকার স্বয়ং রাষ্ট্রেরও থাকা উচিত নয়)। ফলে একই রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও কেউ পান অধিকারের ১০০%, আর কেউ পান অধিকারের ৫%। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলিকে আপাতদৃষ্টিতে (কুশিক্ষার দরুন) অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হওয়ায়, রাষ্ট্র জোর পূর্বক সেসব কাজের সাথে সম্পর্কিত মানুষের অধিকারের এক বৃহদাংশ খর্ব করে। আর যে সব কর্মকাণ্ডকে আপাতদৃষ্টিতে কঠিন বা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনেহয়, সেই সকল কাজের সঙ্গে জড়িত নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারের সীমার বাইরে গিয়েও নানানরকম ভোগবিলাস করার সুযোগ দেয় রাষ্ট্র, যদিও সেটা সাংবিধানিক নজরে অবৈধ হিসাবে গন্য হয়।
আজ আমি প্রাসঙ্গিক কারণবশত একজন কৃষকের উদাহরণ টানতে চাই।
একজন কৃষক তার জীবনকালে কয়েক লক্ষ মানুষের খাবারের যোগান দেন। তার কর্মজীবনের বছরগুলিতে অজন্মার দরুন সৃষ্ট কোন প্রকার ক্ষতির পূরণ রাষ্ট্র তাকে দেয়না। দেশের জন্য আজন্ম খাটাখাটুনিতে রত কৃষক শারীরিক অসুস্থতায় বা আকস্মিক পঙ্গুত্বে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন প্রকার শুশ্রূষা পান না। তাতক্ষনিক প্রয়োজন মেটাতে বা পরবর্তী পঙ্গু জীবন অতিবাহিত করার জন্যে সরকার কর্তৃক কোন রকম অর্থনৈতিক সমর্থন পাওয়ার স্বপ্নও দেখেন না তারা। বার্ধক্যজনিত অসহায়ত্বের বেলায়ও তার অধিকারের ঘড়া থাকে শূন্য। সবচাইতে করুণ পরিনতি ঘটে এই বার্ধক্যেই। দেশের জন্য তার এই সারাজীবনের ত্যাগ, এই অবদান, রাষ্ট্রের অবহেলায় ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। দেশের প্রতি তার অভিমানগুলো ধীরে ধীরে বিতৃষ্ণার রূপ নেয়। পরিবারের সদস্যরাও তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে বৃদ্ধ কৃষক এখন অনাহুত বোঝা ব্যাতিত আর কিছুই নন। কুসন্তানদের লাথি-ঝাটা খেয়ে, ব্যাথায় আর অপমানে জর্জরিত হয়ে, তিনি মৃত্যুর আকুতিভরা প্রহর পাড়ি দিতে থাকেন। হয়তো এক সময় তার আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তাকে স্পর্শ করে।
রাষ্ট্র প্রাণপণে কৃষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অনীহা জানায়। হয়তো কালেভদ্রে কোন বুদ্ধিজীবী মহলের গোপন বৈঠকে কাকতালীয়ভাবে নিজেদের অজান্তেই আমাদের ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে বেড়িয়ে পড়ে কৃতজ্ঞতাবোধের ছিটেফোঁটা, অথবা কোন কবিতার দু’লাইনে। তাও আবার নিতান্ত তাচ্ছিল্যভরে।
কৃষক পরিবারের নারীদের জীবন বার্ধক্যে আরও বেশি বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। সারাটা জীবন পরিবার ও দেশের সেবা করার পর বৃদ্ধ বয়সে জোটে নিজ গর্ভজাত সন্তানদের অবজ্ঞা,অপমান ও মারধোর। কখনওবা ছেলের বউয়ের হাতে গরম খুন্তির ছেকা, আর অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ। দু’মুঠো ভাত আর আদুরে গলায় দুটো কথা শোনার চেয়ে বেশি আসক্তি তাদের ভেতর অবশিষ্ট থাকেনা শেষ বয়সে। অথচ আমাদের দেশ এবং আমরা এই সাধারণ জিনিসগুলিও তাদের কাছে পৌছে দিতে পারছিনা। অত্যাচারিত এই অসহায় মানুষগুলোর কান্নার শব্দ শোনার মতো অবসরও আমাদের কারও কাছে নেই। কতোটা স্বার্থপর আমরা! কতোটা অকৃতজ্ঞ আমাদের এই দেশ!!!
প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে কোন সন্তান তার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভার বহন করায় অস্বীকৃতি জানালে, সরকার সেই বৃদ্ধ বাবা-মাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় বেষ্টিত উন্নতমানের বৃদ্ধাশ্রমে নির্ভয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। সেখানে চব্বিশঘণ্টা স্কিল্ড সেবক-সেবিকা উপস্থিত থাকেন, আরও উপস্থিত থাকেন বড় বড় ডাক্তারেরা। তারা সবাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরকে সন্তানের মতো স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে আমরা অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য এমন কিছু করার প্রয়োজন এখনও বোধ করছিনা, ঠিক যেমনটি পথশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের তাগিদও অনুভব করছিনা। প্রশ্ন হচ্ছে, করছিনা কেন?
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ