জীবনের অর্ধশতক
জীবনের ক্রিকেট ম্যাচে সবুজ ক্রিজে ৫০ বছর পূর্ণের সাদা দাগে ব্যাট স্পর্শ করবো আজ মধ্যরাতে ১১ জুন। ৫০ বছর আগে রাজশাহী হাসপাতালে আমার আম্মা তাঁর জীবনের আশার সওদাগর হিসেবে আমাকে জীবনের এই ক্রিকেট ম্যাচে এনেছিলেন। আমার আব্বা যেন সেই থেকে একজন ক্রিকেট কোচের মতো তাকিয়ে দেখছিলেন এই ক্রিকেটারের সম্ভাবনা।
জন্মের কিছুকাল পরেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায়; আব্বা-আম্মার কোলে চড়ে জীবনের ভয়ে ভোঁ দৌড়ের অভ্যাস হয়ে যায়। ফলে যুদ্ধ হয়ে পড়ে জীবনের ক্রিকেট ম্যাচের প্রতিমুহূর্তে সঙ্গী।
আব্বা-আম্মার সঙ্গে জীবন কোন ক্রিকেট একাডেমির আনন্দ বেদনা সুখকথা যেন। ভালো খেললে আব্বার আদর। খারাপ খেললে আম্মার আশ্রয়। যে টা হয়; বাবারা সবসময় ছেলে পড়ালেখায় ভালো করলে বলেন, তুমি আমাদের ছেলে। আর পড়ালেখায় অমনোযোগ দেখলেই মা’র দিকে ঠেলে দিয়ে মা’কে বলেন, তোমার ছেলেকে দিয়ে জীবনের ক্রিকেট হবে না।
ফলে পড়ালেখা করতে হয়েছে; ভালো ফলাফল করতে হয়েছে। তবে ক্লাস থেকে জীবনের ক্রিকেট খেলার টেকনিক যা শিখেছি; তার চেয়ে বেশি শিখেছি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে।
পরীক্ষা ব্যবস্থা ওপর আমার কোনকালেই আস্থা ছিলো না; কারণ ছাত্র হিসেবেই পরীক্ষা করেছি এই মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে। আমি লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা লেখা প্রায় একইরকম লিখি। সেরকম সবসময় পরীক্ষায় খাতায় একই রকম লিখতাম। বেশির ভাগ পাঠক একই রকম প্রতিক্রিয়া দেন। অল্প কিছু পাঠক বিক্রিয়া দেন। এরকম বেশির ভাগ পরীক্ষকই আমাকে একই রকম নম্বর দিতেন; আর অল্প কিছু পরীক্ষক বিক্রিয়াজনিত নম্বর দিয়েছেন।
পরীক্ষার খাতা সুস্থ পরীক্ষকের হাতে পড়লে নম্বর ভালো আসতো। তখন আব্বা বলতেন, তুমি আমাদের ছেলে। আর পরীক্ষার খাতা বিক্রিয়া শিক্ষকের হাতে পড়লে নম্বর বাজে আসতো। তখন আমি যেহেতু শুধু আম্মার ছেলে; তাই আম্মা জীবনের ক্রিকেট খেলায় বার বার ক্রিজে ধরে রেখেছেন আমাকে; কখনো নৈরাশ্যের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেননি।
আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো পরীক্ষক ছিলো আমার বন্ধুরা। বন্ধুরা অবিরত অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমার জীবনে শত্রুতা হয়নি কারো সাথে। কারণ আমার বন্ধুরা কবিতার মানুষ, গানের মানুষ, আনন্দের মানুষ।
লেখালেখির প্রয়োজনে বন্ধুদের কারো কারো সঙ্গে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে; ঐ সংকটের ক্যানভাসে গল্প বা উপন্যাস লিখে; আবার লেখা শেষ হলে একই রকম বন্ধুত্বে শামিল হয়েছি।
আমার বন্ধুরা বেশিরভাগই রাজনীতি করতো। তারা আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতো। কিন্তু মিছিলে যাওয়ার সময় আমাকে রেখে যেতো। ওদের জীবনে আমার প্রয়োজন চিন্তার সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলো। কিন্তু এরা কেউই আমাকে মারপিটের উপযুক্ত মনে করতো না। ফলে আমার জীবনে মারপিটের সক্ষমতার বিরাট অপচয় ঘটেছে; আমার বাহুবলী বন্ধুদের কারণে।
আজ আমরা কানেক্টিভিটির জগতে বসবাস করে। আমি ঐ বন্ধুদের সঙ্গে ভার্চুয়াল স্বপ্নের ক্যাম্পাসে থাকি; ফলে ” তোমার বাড়ির রঙের মেলায়
দেখেছিলাম বায়োস্কোপ
বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না
ডাইনে তোমার চাচার বাড়ি বাঁয়ের দিকে পুকুরঘাট
সেই ভাবনায় বয়স আমার বাড়ে না।”
লেখালেখির অভ্যাসের কারণে; শিক্ষাজীবনের পুরোটাতেই স্কলারশিপ পেয়েছি। আব্বা এ কারণে বলতেন, লেখাপড়া শেষ করেই প্রথমে দেশের প্রতি ঋণ শোধ করতে হবে। একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ দর্শনের শিক্ষক, কেন ফেসবুকের চেতনা চেকপোস্টের স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকের সুরে কথা বলতেন; আমি অনেকদিন তা বুঝতে পারিনি।
এ কারণে বিসিএস তথ্য সার্ভিসে যোগ দিয়ে জাতীয় বেতার ভবন, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ডিএফপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সাড়ে ছয় বছরের আনন্দময় জীবন কেটেছে জনগণের সেবক হিসেবে।
আর বন্ধুরা ঐ যে লেখালেখি; তা অনেক পাঠকের কাছে জোর করে পৌঁছে দিতে আর টিভি সাংবাদিকতা করাতে ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, চ্যানেল আই-এ জোর করে কাজ করাতো। কবি হুমায়ূন রেজা আর সাংবাদিক মুনির রানা এসাইনমেন্ট দিয়ে লেখাতো, বিষণ্ণতার শহর, তির্যক রচনা। রেজা চ্যানেল আইয়ে নিয়ে গিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ভিত্তিক “খোলা চোখে” অনুষ্ঠান করিয়ে নিতো।
ছাত্রজীবনে বিতর্কে কিছুটা পরিচিতি থাকায় সরকারি চাকরিতে থাকার সময় মন্ত্রী ও সচিবেরা আমাকে দিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো উপস্থাপনা করাতে চাইতেন। সেইভাবেই ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে “জনগণের প্রশ্নঃ প্রধানমন্ত্রীর উত্তর” উপস্থাপনা করা হয়ে যায়।
এই অনুষ্ঠান দেখছিলেন বাংলাদেশ বেতারে আমার বস ও শিক্ষক স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধা সাজাহান ফারুক। উনি লাইভ শো শেষে আমাকে বললেন, তোমার সরকারি চাকরির পাঁচ বছর হয়ে এলো। তোমার আব্বাকে জানাও; দেশের প্রতি ঋণ শোধ করা বেশ কিছুটা হয়েছে। বাকিটা করতে গেলে ধীরে ধীরে বিশ্বঘুরে সেই অভিজ্ঞতা থেকে লেখালেখি করতে হবে। লেখক যেখানেই থাকুক তার লেখার মাঝ দিয়ে ঋণ শোধ হয়।
এরপর অংশ নিই কমনওয়েলথের সিনিয়র প্রফেশনালদের আইডিয়া ইনোভেশন প্রতিযোগিতায়। আমার চিরন্তন আইডিয়া, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য বিতর্ক; ঐ প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সেরা এগারো আইডিয়ার একটি হিসেবে নির্বাচিত হয়। এই আইডিয়াগুলো কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশন; বিভিন্ন দেশের সমাজ উত্তরণে ব্যবহার করে। এতে করে বিশ্বের দরজাটা খুলে যায় আমার জন্য। বৃটেনের রাণী ব্যক্তিগতভাবে বাকিংহাম প্যালেসে বিশ্বের ঐ এগারো আইডিয়াবাজের সঙ্গে রাজকীয় সময় কাটান। আমার কাছে সবসময়ই কফি ওয়ার্ল্ড আর তার উলটো দিকের ঝুপড়ির চায়ের দোকান একই রকম আনন্দের। ফলে বাকিংহাম প্যালেস আমার কাছে ঔপনিবেশিক শাসকের ময়ূরপ্রাসাদ ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। রাণী আমার এই আইডিয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন। বাকিং হাম প্যালেসে কেমন লাগছে প্রশ্নের উত্তরে উনাকে কলোনিয়াল গ্র্যানি বলে সম্বোধন করি। আর উনার লাইলাক রঙের এটায়ারের প্রশংসা করি। উনি দাদিমার মতোই শিশুদের মতো হেসেছিলেন। সম্পর্ক খুব মৌলিক ব্যাপার; পৃথিবীর সব নানী-দাদী একই রকম স্নিগ্ধ।
দেশে ফিরে জাতীয় বেতার ভবনে দেখি; ডয়চেভেলের সম্পাদক হিসেবে কাজ করার যে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম, তার চিঠি এসেছে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়ে।
বিএনপি সরকারের সহমত ভাইয়েরা লিয়েন আবেদন আটকে রাখলেও; সিভিল সার্ভিসের সিনিয়ার অঞ্জন চাকমা তার বন্ধুদের দিয়ে ছুটির অর্ডার নিষ্পন্ন করেন।
বাংলাদেশ ছেড়ে জার্মানির পথে পা বাড়ালাম। বস হিসেবে পেয়ে গেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল ফারুককে। উনি প্রথম দিনই বললেন, তুমি যথেষ্ট মিডিয়া প্রশিক্ষণ পেয়েছো; ভালো শিক্ষক পেয়েছো। এইটা আর বিশেষ কিছু শেখার নাই। অনলাইন মিডিয়া ট্রেনিং নিয়ে ঋদ্ধ হও। আর লেখালেখিতে মন দাও। গোটা বিশ্বের প্রায় ৩১ টি ভাষার নানাদেশের মানুষকে ডয়চেভেলেতে পেয়ে যাই। বিভিন্ন দেশ আর মানুষের বৈচিত্র্যময় সান্নিধ্যে; জীবন সম্পর্কে আমার যে মৌলিক ধারণা; বৈচিত্র্যেই আনন্দ; হাত বাড়ালেই বন্ধু; তার প্রমাণ পেতে শুরু করলাম প্রতিদিন।
কিন্তু পশ্চিমের জীবন এক নিশ্চল মঞ্চ। সব কিছু ঠিক ঠাক চললে; জীবনের মজাটা থাকে না। কত রাতই বা মানুষ ডিসকোতে নাচতে পারে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াতে জীবন-মৃত্যুই তো আনন্দ বেদনার ডিসকোতে নাচা। আর আমার কাছে জীবনের সংজ্ঞা হচ্ছে, আশৈশব বেড়ে ওঠা ঈশ্বরদী রেল জংশনের মৌতাত; রেল রাস্তা-রেল গাড়ির ঝম ঝম শব্দ; তাতে গতির বাড়ই।
আবার দেশে ফিরলাম; আনন্দে কাজ করলাম; বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ। এখানে বস তৌফিক ইমরোজ খালিদি। উনি আমাকে একদিন বললেন, তোমার কিছু বই পড়লাম। এতো বই কী করে লিখলা এতো অস্থির একটা মানুষ। তৌফিক ভাই আমাকে সুস্থির বানাতে কফি ওয়ার্ল্ডে নিয়ে গিয়ে উনি সাংবাদিকতার যা জানেন তা শেখাতে থাকলেন। টেলিভিশন অনুষ্ঠান হোস্ট করা, প্রামাণ্য চিত্র বানানো এসবে ব্যস্ত রাখলেন; নিউজ রুমে কাজের পাশাপাশি। খুব আনন্দময় সময় কাটলো নিউজরুমে। দাপুটে এক টিম। টোয়েন্টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের মজা আছে বিডি নিউজ টোয়েন্টি ফোরের নিউজ গ্রাউন্ডে।
আমার বন্ধু অধ্যাপক কাজী মারুফ (তুষার) একদিন কফি খেতে খেতে বললো, আপনার বয়স আটত্রিশ হলো জুনে; এখন দ্য-এডিটর ডট নেটের সম্পাদক হলে; সাংবাদিকতা জীবনের ক্রিকেট টিম ক্যাপ্টেন্সির আনন্দও পেলেন; আবার কিছু শিখলেন কিছু শেখালেন তরুণদের।
এমিনেন্স বাংলাদেশের সিইও শামীম তালুকদার স্বাস্থ্য-তথ্য সঞ্চালনে আগ্রহী হয়ে দ্য এডিটর ডট নেট পরিচালনা করতো বেঙ্গল গ্রুপের উদ্যোগে। সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আমার দেখা পেয়ে। উন্নয়ন গণমাধ্যম হিসেবে দ্য এডিটর ডটনেট ছিলো এক হ্যাপেনিং প্লেস। প্রায় প্রতিসপ্তাহে প্রেসক্লাবে স্বাস্থ্য বিষয়ক সেমিনার; ওদিকে আমার বিতর্কের সারথিদের অনুষ্ঠানে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে উপস্থিত থাকা। দ্য-এডিটর ডটনেটের উদ্যোগে “স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে বিতর্ক কনসার্ট শেষ করে” আনন্দচিত্তে এবার আবার দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ জীবন আনন্দময় হলেও মূল আনন্দ লেখালেখির ভুবন বিনির্মাণে এক টুকরো নিরবতা প্রয়োজন।
সেই নিরবতা খুঁজে পেলাম পাকিস্তানের করাচিতে। হোম অফিস আর অনলাইন মিডিয়া ই-সাউথ এশিয়ার যে করোনা-বান্ধব জীবন তা শুরু হলো ২০১০ সালে। সঙ্গে যুক্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। মিডিয়া স্টাডিজ, মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, ফিল্ম আর সোশ্যাল স্টাডিজ পড়াতে থাকলাম szabist, আইওবিম, এস এম আই ইউ নামের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নেশন ওয়াইড এফ এম চ্যানেল মাস্ট এফ এম ওয়ান ও থ্রি’তে পাঁচবছর বাংলা সার্ভিস চালিয়ে বাংলা বৈঠক অনুষ্ঠানটি নিয়ে এলাম অনলাইনে; ই-সাউথ এশিয়ায়। পাশাপাশি মিডিয়া উপদেশনার কাজ চলতে থাকলো। লেখালেখির নিভৃতির প্রয়োজনে; ঠিক যত ঘন্টা সময় অর্থের বিনিময়ে দিতে পারি; তত ঘন্টা সময় দিই এখন। জীবন আমার সিদ্ধান্ত আমার। তাই আমি কাকে কতটুকু সময় দিতে পারবো তা রইলো সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে।
করোনাকালে জীবনের অর্ধশতক পূর্ণের কয়েকঘন্টা আগে; বাঙ্গালির অনিবার্য কী পেলাম কী পেলাম না অডিট এন্ড একাউন্টসের খেরো খাতা খুলে দেখলাম। জীবনে ঠিক যেরকম ইনসেপশানে যতটা আনন্দে থাকতে চেয়েছিলাম; জীবন আমাকে ঠিক তাই দিয়েছে। আর নারী সম্পর্কে জীবনের অর্ধ শতকে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি; যা কিছু কল্যাণকর; বেশির ভাগই তার করিয়াছে নারী; কিছুটা করেছে নর।”
পঞ্চাশ বছর বয়স আত্মজীবনী লেখার সময় নয়। বয়স ষাট না হলে আত্মজীবনী লেখা ঠিক নয়। তাই প্রেম-পরিণয়-সন্তান; স্বপ্নের এই শাখা প্রশাখার গল্প তুলে রাখলাম; করোনার করুণায় যদি বাঁচি; সে সময়ের জন্য। একমাত্র করোনাই পারে; করোনাই পারবে আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দিতে। হ্যশট্যাগ ধন্যবাদ করোনা।
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ