ঘৃণার বীজ
যে বিষয়টি নিয়ে বলবো, আমার বন্ধু তালিকায় অনেকেই আছেন যারা বিষয়টি সম্পর্কে আমার চেয়ে অনেক বেশি ভাল ধারণা রাখেন। তবুও তাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিতে, আর যারা বিষয়টি জানেন না বা কখনও ভেবে দেখেননি তাদের জন্য বলছি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই (প্রায় সবাই) গরু বা শুকরের মাংসের কথা শুনলেই ওয়াক থু বলে ফেলেন নিজের অজান্তেই। প্রায় বমি চলে আসার উপক্রম হয়। কিন্তু কেন?
হ্যা, ধর্মে নিষেধাজ্ঞা থাকতেই পারে। সেজন্য আপনারা যার যার পছন্দ মতো এ দুটি মাংসের যেকোন একটিকে অথবা দুটিকেই এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু বমি আসার মতো এতোটা ঘৃণার উৎপত্তি হয় কোত্থেকে? দুটি মাংসের স্বাদ প্রায় একইরকম। দুটি মাংসই সমানভাবে পুষ্টিকর প্রোটিনের যোগান দেয়। দুটি মাংসেই চর্বির পরিমাণ সমান এবং বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস বা কৃমির বীজ ধারন ও বহন করার ক্ষমতাও সমান। তাই অসতর্ক ভাবে খাওয়া হলে দুটি মাংসই স্বাস্থ্যের জন্য সমান ভাবে ক্ষতিকারক হতে পারে। তাহলে একটির প্রতি ভালবাসা আর অন্যটির প্রতি এতোটা ঘৃণাবোধ কীভাবে জন্মায়?
এই ঘৃণা একদিনে জন্মায় না, দু’দিনে জন্মানো সম্ভব নয়। আপনারা শিশুকাল থেকে এই ঘৃণা চর্চার ভেতরে বেড়ে উঠেছেন। বাবা-মায়েরা, পাড়াপ্রতিবেশিরা, বিভিন্ন গুরুজনেরা আপনাদের শিখিয়েছেন এই দুটি মাংসের যেকোন একটিকে মন উজাড় করে ঘৃণা করতে।
বছরের পর বছর ধরে বাড়ির ভেতরে, রান্নাঘরে, খেলার মাঠে, স্কুলে, বাজারে, উপাসনালয়ে, মোটকথা ছেলেবেলা থেকে যতরকম জায়গায় যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে , তার প্রায় সব জায়গাতেই চারপাশের সবাইকে এই ঘৃণা বলতে ও চর্চা করতে দেখে এসেছেন। আর তাই আপনার অবচেতন মন এবং শরীর এই ঘৃণাকে আয়ত্ত করে নিয়েছে তাদের মতো করে। ঘৃণা শিখে প্রতিনিয়ত তার চর্চা করতে করতে আপনি ঘৃণা করাটাকে আপনার দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করেছেন। এজন্য গরু বা শুকরের মাংসের নাম শোনা মাত্রই আপনাদের শরীরের স্নায়ুতন্ত্র এমন ভাবে উদ্বেলিত হয়, কিছু হরমোন এমন কিছু স্টিমুলেশন পাঠায় মস্তিষ্কে যে আপনি নিজের অজান্তেই ওয়াক থু বলেন। হয়তো বমিও করে ফেলেন।
অনুরূপ ভাবে, ছোটবেলা থেকে আপনারা আরও এক প্রকারের ঘৃণা শিখে এসেছেন। আড্ডার মহলে, পারিবারিক গাল-গল্পে, স্কুলের ক্লাসে, অথবা মাইকে তারস্বরে চিৎকার করে অনেককে অগণিতবার বলতে শুনেছেন যে খ্রিস্টান, ইহুদী, নাস্তিক বা শিয়া মুসলিমরা ভীষণ রকম খারাপ। এরা ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য। অতীত থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে আসন্ন পৃথিবীর প্রায় সবগুলো ক্ষতির কারণ এরা। এরা যে কাজই করুক না কেন, তা মোটেই ভাল ফল বয়ে আনেনা। এরা সর্বদাই ব্যস্ত থাকে সত্যের পথে (?) চলা মানুষগুলির ক্ষতি করতে।
হয়তো এমনও বলতে শুনেছেন, এই খ্রিস্টান,ইহুদী, নাস্তিক বা শিয়া মুসলিমরা যেভাবে যেটাই করুক, আপনাদের নিজেদের তার উল্টোটা করা উচিত। তাদেরকে কখনওই বিশ্বাস করা উচিত না, তাদের সাথে কখনও বন্ধুত্ব করা উচিত না, তাদেরকে সব সময় দমন করা উচিত। সর্বোপরি তাদেরকে মনের অন্তরস্থল থেকে ঘৃণা করা উচিত।
শুধু যে শুনেছেন তা নয়। আপনারা পরিবারের জেষ্ঠ্য সদস্যদের, স্কুলের শিক্ষকদের, উপাসনালয়ের পথ প্রদর্শকদের এবং বন্ধুবান্ধবদের, মোটামুটি সবাইকেই একযোগে এই ঘৃণাবাদ কোনরকম আপত্তি ছাড়াই মেনে নিতে এবং নিয়মিত চর্চা করতে দেখেছেন তাদের কথাবার্তায়, চলাফেরায় এবং কাজেকর্মে। এমনকি আপনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার একাংশও আপনাকে একইভাবে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। আপনি কখনওই প্রয়োজন বোধ করেননি এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করে দেখার। কারণ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র দ্বারা প্রদত্ত যতো প্রকারের জায়গায় আপনার শিক্ষা ও জ্ঞান লাভের সুযোগ হয়েছে, তার সব জায়গাতেই আপনাকে এই একই ঘৃণার মন্ত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শেখানো হয়েছে।
আপনার শিক্ষানবিশ মন নিজের অজান্তেই দিনে দিনে আপনারই পূর্বসূরিদের মতো আরেকটি ঘৃণার দানবে পরিনত হয়েছে। আর তাই ইহুদী -নাসারা, খ্রিস্টান, নাস্তিক অথবা শিয়াদের নাম শুনলেই আপনার স্নায়ুতন্ত্র এবং হরমোনগুলো আপনাকে বাধ্য করে তাদের ঘৃণা করতে, অবিশ্বাস করতে, তাদের ক্ষতি করতে। তখনই আপনি মানুষ থেকে জানোয়ারে রুপান্তরিত হন। এই ঘৃণা বন্ধ হওয়া দরকার।
অতি আশ্চর্যের বিষয় হলো ২০২০ সালের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও মুক্ত জ্ঞান চর্চার যুগেও দেশে ঘৃণাবাদের চর্চা বন্ধ তো হয়নি, বরং দিনে দিনে আরও প্রকট আকার ধারন করছে।
কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ী পঙ্গু শিক্ষায় শিক্ষিত জনগনের সমর্থনে এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘৃণার ভাইরাস ছড়িয়ে চলেছে দেশের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে, বিভিন্ন ইভেন্টের মাধ্যমে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ঘৃণার এই সংক্রমণ আরও সবল হয় যখন বাংলাদেশের মতো তথাকথিত শিক্ষিতের দেশে গনমাধ্যমগুলিও এই ঘৃণার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, অথবা স্বার্থের বশবর্তী হয়ে স্বকীয়তা ও বিবেক জলাঞ্জলি দিয়ে বসে।
বিগত বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি ঘৃণাবাদের কাণ্ডারীরা বিভিন্ন গনমাধ্যমে বহাল তাবিয়তে ঘৃণা ছড়িয়ে চলেছেন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতেও সমাদরের সঙ্গে তাদের ঘৃণা চর্চার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। দেশের অশিক্ষিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক অপশিক্ষায় জর্জরিত মানুষেরা স্বভাবতই টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা মুখগুলিকে অবলীলায় মহাগুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তাই সেই মুখগুলি থেকে নিঃসৃত বিষকে অমৃত হিসেবে গ্রহন করে নিজেদের দূষিত করে তুলতে এরা বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করেনা। সরকার ও মিডিয়াগুলিতে সঠিক-বেঠিক বিচার করার মতো লোকের ঘাটতি না থাকলেও নপুংসকের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকে তাদের আদর্শ। অথচ এখনই সময় নিজেদের শুধরে নেওয়ার। ভালবাসতে শেখার। সময় সবাইকে হোমোস্যাপিয়েন্স ভাবতে শেখার। আমি জানিনা ঠিক কোন স্বার্থকে মাথায় রেখে সরকার এবং মিডিয়ার বুদ্ধিজীবি মানুষগুলো এখনও এর প্রতিকারমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহন করছেন না।
বিশ্বাস করুন, আমি নিজে জীবনের একটা লম্বা সময় নাস্তিক, ইহুদী-খ্রিস্টানদের মাঝে থেকেছি শুধু মানুষ পরিচয়ে। এখন শিয়া মুসলিমদের সাথে আছি। আমি কখনওই এদের মধ্যে ঘৃণা করার মতো কোন বিষয় খুঁজে পাইনি। বরং এরা আমার ভালবাসার ক্ষমতা শতগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে বিনিময়ে কিছু না নিয়েই। এরা আমাকে মন খুলে অসংকোচে ভালবেসেছে। আমিও এদেরকে মন উজাড় করে ভালবাসতে পেরেছি, এখনও পারছি। বছরের পর বছর একসাথে থাকার পরও এরা আমার ধর্মীয় দর্শনের প্রতি কোন আগ্রহ দেখায়নি। আমি হিন্দু,মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদী নাকি নাস্তিক এরা কেউ জানেনা। জানার প্রয়োজন বোধ করে না। এরা শুধু জানে মানবতার ধর্মকে পুজি করে মানুষকে ভালবাসতে, সহযোগিতা করতে। জেনে-না জেনে আপনার পূর্বসূরিরা এদের সবার কাছ থেকে নানানরকম সেবা পেয়ে এসেছেন। আপনিও তা পাচ্ছেন, আপনার সন্তানেরাও পাবে। তাই সবাইকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করতে শিখুন, সমানভাবে ভালবাসতে শিখুন।
“আমরা এবং ওরা”, এমন পৃথকীকরণ একশোটা করোনার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর। আমরা ছোট্ট এই জীবন পেয়েছি শুধুই ভালবাসার জন্য। ঘৃণার জন্য আমাদের জীবন খুব ছোট।
–আজারবাইজান টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি, আজারবাইজান
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ