গুণীজনের মৃত্যু, বিভাজিত সমাজ, চিন্তা

  কাকন রেজা:

এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোকের মধ্যেও একটি আশাপ্রদ বিষয় খেয়াল করেছেন কি? তার মৃত্যুকে কেউ রাজনৈতিক বিভাজনে বিভাজিত করেননি। এই দেশের এক যুগের স্বাভাবিক চিত্র ও চরিত্র দাঁড়িয়েছে কেউ মারা গেলে তার শারীরিক পোস্টমর্টেমের আগে চারিত্রিক পোস্টমর্টেম শুরু হয়ে যায়। একপক্ষ মাতম করে, অন্যপক্ষ উল্লাস। এন্ড্রু কিশোর আপাত বেঁচে গেছেন এই বিভাজনের হাত থেকে। গুণীদের খুব সৌভাগ্যবান ছাড়া কেউ বাঁচতে পারেননি এমন তাৎক্ষণিক অসভ্যতা থেকে। অপ্রকৃতিস্থ বিভাজিত চিন্তা থেকে।

অপ্রকৃতিস্থ কেনো বললাম শুনুন। গুণী একজনের মৃত্যুতে যখন শোকবার্তায় বলা হয়, ‘তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করি। কিন্তু তার মতবাদে আমি বিশ্বাস করি না। তিনি একটি ভুল মতবাদের সমর্থক ছিলেন। তারপরেও তার মৃত্যুতে শোক জানাই।’ না, এটা ঠিক কল্পিত শোকবার্তা নয়, এটা বাস্তবতা। একজন মানুষের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করতে পারেন, শোকের আড়ালে এমন উল্লাস প্রকাশ করা অপ্রকৃতিস্থতা। আর অন্যের ভুল প্রমানে নিজেকে ভালো জানান দেয়ার চেষ্টা স্রেফ মানসিক বিকার।

আপনার পছন্দ নয়, চুপ থাকুন। শোকের নামে নিজের অসুখের প্রকাশ করা কেনো! কেনো উল্লাসের নামে বিকারগ্রস্ততা! মৃত মানুষের কাজ নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে জীবনভর। মৃত্যুর সাথেই সাথেই তার কাজ ও চরিত্রের ময়নাতদন্তে নেমে পড়তে হবে। সেদিনই লিখতে হবে মানুষটা খারাপ ছিলো, কেনো? সময় সবারই মূল্যায়ন করে। ভাস্কো দ্য গামা’র মূর্তি গড়া হয়, আবার তা অপসারিত হয়। ভাস্কো দ্য গামা আবিস্কারক হয়ে উঠেন, আবার সময় তাকে তস্কর হিসাবে চিহ্নিত করে। মানুষের কাজের মূল্যায়ন সময়ে পরিবর্তিত হয়। সেই সময়ের অপেক্ষা না করেই সদ্যমৃত মানুষকে নিয়ে যারা সমালোচনায় নেমে পড়েন, তাদের মানসিক স্থিতি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ সঙ্গত এবং স্বাভাবিক।

মনোবিজ্ঞান এমন বিষয়কে মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রতিহিংসাপরায়নতা হিসাবে আখ্যা দিয়েছে। পিয়াস করিম যখন মারা গেলেন, তার মৃত্যু পরবর্তীতে যা হলো, তা নিয়ে লিখেছিলাম। মৃতের শরীরকে অসম্মান করার যে প্রবণতা তা চরম বিকারের সামিল। ধর্ম, সমাজ এবং নৈতিকতা সবই এমন কাজের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারপরেও তা করা হয়, হয়েছে। পিয়াস করিমের মৃতদেহও তেমন অনৈতিকতার কবলে পড়েছিলো। সে নিয়ে ছিলো আমার লিখা। সে লিখাও গায়ে বেঁধেছিলো কারো কারো। একজন তো মুখের উপরই বললেন, ‘আপনাকে আমি প্র্রগতিশীল বলেই জানতাম, আপনি পিয়াস করিমের পক্ষ নিলেন।’ তার কথার ক্ষুব্ধতাই প্রকাশ করছিলো তার ভেতরের প্রতিহিংসাপরানয়তা। বিস্মিত হয়েছিলাম, কারণ তিনি নিজেও স্বঘোষিত প্রগতিশীল। মূলত এনারা হলেন প্রগতি কী তা না বুঝেই গতিশীল হওয়া মানুষ। যাদে এক অর্থে ‘ন-মানুষ’ বা ‘উনমানব’ও বলা যায়।

মানুষের চিন্তা পরিবর্তন ঘটে সময়ের সাথে। মানুষ তার ধারণাগুলিকে নিজের মধ্যেই যাচাই-বাছাই করতে থাকে। আর যারা তা না করেন, তাদের আসলে মেধাভিত্তিক কোনো বিষয়ে না জড়নোই ভালো। চিন্তার একটা জায়গায় বসে থাকাও একধরণের মৌলবাদ। ধর্মের ব্যাখ্যাও সময়ের সাথে টিউনড হয়। ধর্মও সময়কে ধারণ করে ব্যাখ্যা দিতে বলে। অথচ ‘ন-মানুষ’দের রাজনৈতিক চিন্তার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। আর যাদের ঘটে না, তারাই সবচেয়ে বড় মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল। বিশ্বের, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক চিন্তা আর কৌশলের পরিবর্তন ঘটে। সমাজতান্ত্রিক চীনেও এক ধরণের অর্থনৈতিক পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে। চীনের এই রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে মূল কম্যুনিজমের চিন্তা যায় না। অথচ চীন তার স্বার্থেই অর্থনীতির এমন কাঠামো দাঁড় করিয়েছে। সুফলও পেয়েছে তারা। সুতরাং চিন্তার পরিবর্তন বা সংস্কার দোষের কিছু নয়।

বিপরীতে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় প্রগতিশীলতার নামে এক ধরণের গোয়ার্তুমি চালু রয়েছে। যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ ধরণের চিন্তা নির্ভর প্রতিহিংসাপরায়ণতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল। যেতে হচ্ছে এখনো। আর তা ক্রমে না কমে বেড়ে উঠছে বহুগুন। আর বেড়ে উঠার পেছনে রয়েছে স্বার্থগত পৃষ্ঠপোষকতা। হিংসা চালু থাকলে বিভাজিত হয় সমাজ। বিভাজন সবসময়ই শোষণ সহায়ক।

লিখা শুরু করেছিলাম এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে, মাঝখানের গাইলাম শিবের গীত। এন্ড্রু কিশোর ছিলেন আমাদের তারুণ্য আর যৌবনের সাথী। সে সময়ের অনভূতিকে আলোড়িত করেছেন গানে। প্রেম-প্রণয়ে তিনি ছিলেন যৌবনে অপরিহার্য। ‘আমার সারা দেহ খেয়ে গো মাটি’ শুনলেই আমাদের সময়ের প্রণয়-সিক্ত মানুষের চোখ ভিজে উঠতো। আহা, সোনালী সময়। আমাদের সোনালী সময়কে আরো চকচকে করেছেন এন্ড্রু কিশোর। বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের একজন আইকন তিনি। অসুস্থ না হবার আগ পর্যন্ত যিনি মানুষকে আনন্দ বিলিয়ে গেছেন। আরেক জীবনে তিনি আনন্দে থাকুন, ভালো থাকুন, তার জন্যে এই প্রার্থনা।

লিখেছেন: কাকন রেজা, প্রাবন্ধিক, লেখক ও সাংবাদিক

You may also like...

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।