অনিক খান

অনিক খান একজন ছড়াকার। এরই সাথে তিনি উন্মাদ এর নির্বাহী সম্পাদক এবং “তবুও” নামের একটি মধ্যমাসিক গৃহপত্রের কনটেন্ট ও পরিকল্পনা প্রধান। মাঝে কিছুদিন রেডিও ফুর্তির প্রযোজক ও আর.জে হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সাল থেকে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। ছড়া-কবিতা দিয়েই শুরু। তার প্রথম মৌলিক লেখা ছাপা হয় উন্মাদ পত্রিকায় ‘অনিকের শের’ শিরোনামে। এরপর আর থামাথামি নেই। জনপ্রিয় এই ছড়াকার এর সাথে সম্প্রতি এক একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার মনের কিছু কথা। এখানে তার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল আলম বাবন। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১১।

এত কিছু থাকতে লেখালেখিতে কেন এলেন এবং কবে থেকে?
এই একটা কাজই পারতাম। সবাই যেমন স্কুলের খাতার পিছনে আঁকিবুকি করে, আমি তেমন ছড়া লিখতাম। কখনও নিজের, কখনও যাদের লেখা ভালো লাগতো সেগুলো। শুধু ছড়া নয়, কবিতা, গান এমনি এমনি বিচ্ছিন্ন শব্দ ইত্যাদি। এভাবেই আস্তে আস্তে- সিরিয়াসলি লেখা শুরু করে দেই। পুর্নাঙ্গভাবে ১৯৯৮ সাল থেকে উন্মাদের মাধ্যমে মৌলিক লেখালেখি শুরু করি।

লেখার অনুপ্রেরণা কারা?
অনুপ্রেরণা পেয়েছি জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকেই। কবি হেলাল হাফিজ, রুদ্র মোঃ শহিদুল্লাহরা যেমন আমাকে তাদের কবিতা দিয়ে প্রেম ও দ্রোহের পথে নিয়েছেন তেমনই বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনারা আমাকে রাজনৈতিক ছড়া লেখায় বাধ্য করেছেন। একইসাথে বেদনার স্বরূপ শিখিয়েছেন আমাকে আমার তরুন প্রেম ও বিরহী বন্ধুগন। আমি তাদের সকলের প্রতি ভীষন কৃতজ্ঞ।

ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ছড়া বা কবিতা বেশী গ্রহণযোগ্য না গল্প বা উপন্যাস?
আমি মনে করি গ্রহনযোগ্যতা ব্যাপরাটা ‘জনপ্রিয়তার’ সাথে কিছুটা বাড়ে কমে। আশি দশকের পর থেকেই মানুষ কবিতা থেকে গল্প উপন্যাসের দিকে বেশী ঝুঁকেছে। বই বিক্রয়ের হিসাব থেকে সেটাই বলা যায়। তবে উচিৎ হচ্ছে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তার বক্তব্য সুন্দর ও সাবলীল করে তুলে ধরবে সে মাধ্যমেই যে মাধ্যমে তিনি নিজে সাচ্ছন্দ বোধ করেন। ফটোগ্রাফার ছবি তুলবেন, কবি কবিতা লেখবেন, সঙ্গীত শিল্পী গান করবেন। মুশকিল হয়ে যায় যখন ‘মিডিয়ায় থাকা জরুরী’ বলেই বিউটিশিয়ানরা সম্পাদক, আমলারা গায়ক আর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররা চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়ে যায়।

ছড়া তো অনেক লিখলেন কিন্তু গল্প বা উপন্যাস কেন লিখেন না?
ওই যে বললাম আমি পারি শুধু ছড়া লিখতে। তবু অনেকের কথায় গল্প লিখার চেষ্টা করেছি, দুয়েকটা লিখেছিও। এখানে দুটো সমস্যা। এক, আমার গল্পগুলো অন্য লেখকদের তুলনায় খুব নিপাট অখাদ্য হয়েছে। দুই, যখনই কোন গল্পের প্লট মাথায় আসে, ওটা দিয়ে একটা ছড়া লিখে ফেলি। পারিই তো ওই একটা জিনিস, আমার কি দোষ বলেন?

ইদানিং কবিতা চর্চা কম হওয়ার কারণকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
কোথায় কম হচ্ছে? কোন বিয়ের দাওয়াতে গেলেও তো ভয়ে ভয়ে থাকি কখন কে জানতে চায় ‘ভাই আপনি কি করেন?’। কেউ জানলেই হলো যে আমি পত্রিকায় কাজ করি ব্যাস প্রথম কথাই হলো ‘আপনারা কবিতা ছাপেন? আমার কিছু কবিতা আছে, আপনার ভাবী আবার ইদানিং খুব জোর করছে কেন এত ভালো কবিতগুলো কোথাও না ছেপে ফেলে রেখেছি?’। উইথ অল ডিউ রেসপেক্ট, দেশের আপামর কবি ভাই ও একনিষ্ঠ পাঠিকা ভাবীদের যন্ত্রনায় মনে তো হয় না কবিতা চর্চা কম হচ্ছে।

যুগের চাহিদার কারণেই কি এখন কবিতার বইকে কম প্রধান্য দেয়া হচ্ছে?
তাই তো মনে হয়। কিন্তু পাঠক কম কিনলেও কবিতার বই কিন্তু প্রচুর প্রকাশ হচ্ছে।

নবীনদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের অনীহাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ণ করতে চান?
নবীনদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের অনীহাকে আমি খুবই উচ্চ দরে মূল্যায়ণ করি। আমার তো মনে হয় অত্যাধিক বেশী বই প্রকাশিত হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। একজন লেখকের জীবনে একটি বই প্রকাশিত হওয়া একটি মাইলস্টোনের মত। উচিৎ হলো এই যে- নবীণ প্রবীন সবারই বই প্রকাশ হবে তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে। অনেক বই প্রকাশ হচ্ছে যেগুলো আমার কাছে মনে হয় যে সেগুলো প্রকাশের কোন দরকার ছিল না। খামাখা গাছ কেটে বানানো কাগজগুলো নষ্ট করা হলো। আমার নিজেরই বইগুলোর ভেতর অন্তত অর্ধেক বই প্রকাশিত হওয়ার কোন দরকার ছিল না। যুগ আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে বলেই আমার এতগুলো বই বাজারে এসেছে। এখানে আমার কৃতিত্ব নেই বললেই চলে। আমার মত ও আমার চেয়েও খারাপ কিছু লেখকের কারণে অনেক নবীন প্রতিভাবান লেখক সুযোগ হারাচ্ছেন। আমার চেয়েও খারাপ হলেন তারা, যারা নিজের গাঁটের পয়সায় বই প্রকাশ করেন।

নবীন প্রতিভা উন্নয়ন কিভাবে হবে?
জবাবটা হাস্যকর ও অসম্ভব শোনাবে, তবুও বলছি একমাত্র প্রকৃত মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা ছাড়া নবীন প্রতিভার উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। এখন জনপ্রিয়তার যুগ। নবীন লেখকদের ক্ষেত্রে সম্পাদক প্রকাশকদের উচিৎ লেখা ছাপানোর মাধ্যমে নবীন লেখকদের পাঠক মহলে জনপ্রিয় করার ব্যবস্থা করা।

বর্তমানে পেশা হিসাবে লেখালেখিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমানে লেখালেখিকে পেশা হিসাবে নেয়ার একটি উত্তম সময় বলে মনে করি। দেশে পত্রিকা, টিভি রেডিও চ্যানেলের তো অভাব দেখছি না। সবারই প্রয়োজন ভালো সাংবাদিক, স্কৃপ্টরাইটার ইত্যাদির।

একজন লেখকের পেশা কি শুধু লেখাই হওয়া উচিৎ নয় কি?
হলে তো ভালোই হয়। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন আর সৃজনশীল মানুষের জন্য মাল্টিটাস্কিং হওয়াটাতো কঠিন কিছু নয়।

আপনি ‘তবুও’ নামের একটি পত্রিকা বের করেন। পত্রিকাটা বিক্রি করা হয় না। পাঠকের জন্য একেবারে ফ্রি। এর চিন্তাধারা কোথা থেকে এল এবং কেন?
আমি পড়ালেখার জন্য একটা সময় অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম। তখন আমার লেটার বক্সে প্রচুর পরিমান বিজ্ঞানপত্র আসতো। আমি ভাই ‘৩য় বিশ্বের মানুষ’ তাই প্রথমে রং ঝলমলে এই ম্যাগাজিন আকারের ক্যাটালগগুলো হাতাতে ভালোই লাগতো। কিন্তু সেগুলো এত বেশী আসতো যে এক পর্য্যায়ে আমার ১ম বিশ্বের প্রতিবেশীদের মত আমিও বিরক্ত হয়ে ‘দয়া করে ফ্রি পত্রিকা দিবেন না’ বলে চিঠির বাক্সে নোটিস ঝুলিয়ে দিলাম। তখনই আমার মনে হতো যে এত সুন্দর কাগজে এত সুন্দর ছাপা বিজ্ঞাপনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে যদি এই মূর্খগুলো যদি আমার দুটো করে ছড়াও ছাপতো তাহলেও তো অন্ততঃ আমি আর আমার কিছু বন্ধু-শত্রু কিছুটা হলেও আগ্রহ নিয়ে জিনিসটা গ্রহন করতাম। সেখান থেকেই তবুও করার কু-বুদ্ধিটা মাথায় আসে। আমাদের তবুওর নিয়মিত গ্রাহক সংখ্যা এখন ছয় হাজারেরও বেশী।

‘তবুও’ কে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?
একটি ভালো পর্যায়ে দেখতে চাই।

‘উন্মাদ’ পত্রিকা নিয়ে আপনাদের স্বপ্ন কি?
প্রায় বিজ্ঞাপন ছাড়াই শুধুমাত্র পাঠকের ভালাবাসায় উন্মাদ পত্রিকায় এখনও বেঁচে আছে। যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অসম্ভবই বলা চলে। আর তাই পাঠকের ভালবাসায় আরও কিছুদিন বেঁচে থাকাটাই আমাদের আপাতত ভবিষ্যত পরিকল্পনা। আর এছাড়া বাইরের কিছু প্রতিষ্ঠান আমাদের সাথে জড়িত হচ্ছে। রেডিও টুডে, উন্মাদ বাইপ্রডাক্টস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানরা তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রমে উন্মাদকে জরুরী মনে করছে, তাদের সাথে পথ চলতে আমরা এখন পর্যন্ত খুব একটা আপত্তি করছি না। দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়।

এবারের বইমেলাতে আপনার কয়টি বই প্রকাশিত হচ্ছে?
১টি। বইটির নাম ‘সমগ্র অনিক খান’। প্রকাশক ‘বিভাস’।

দেশের প্রিয় ছড়াকার কে?
অবশ্যই আবদার রশিদ, লুৎফর রহমান রিটন, রোমেন রায়হান ও ওবায়দুল গনি চন্দন। আর শৈশবে আবু সালেহর ‘পল্টনের ছড়া’গুলো আমার কাছে অসাধারণ লেগেছিল। এই সময়ের ফয়েজ রেজার লেখা আমার দারুণ লাগে। আমি প্রচুর ছড়া পড়ি। যেখানে পাই সেখানেই। বই মেলায় লটারী টিকিটের অন্ধ হকার যখন চিৎকার করে আওরায় ‘গাড়ি বাড়ি হোন্ডা/কেডা নিবেন কোন্ডা?’ সেটাও আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। আমার ভালো লাগে। কাজেই যাদের নাম উল্যেখ করলাম তারা ছাড়াও আমার আরও অনেকের অনেক প্রিয় ছড়া ও ছড়াকার আছে। সবার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে অনেক প্রিয় ছড়াকারের নাম ইচ্ছা করেই একটা চিকন অভিমান থেকে উল্ল্যেখ করলাম না যারা অনেক অসাধারণ ছড়া লিখেও এখন অন্য মিডিয়ার চাপে আর ছড়া লেখেন না।

বিদেশের প্রিয় লেখক?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ফেব্রুয়ারী এলেই বই নিয়ে শুধু এই একমাস মিডিয়ার মাতামাতি দেখা যায়। আপনার কি মনে হয় না সারা বছর ধরে বই নিয়ে মিডিয়ার আর একটু নজর থাকা দরকার?
নাহ, দরকার না। বছরে ৩৬৫ দিনের ভেতর কবি-লেখকরা অন্ততঃ ২৮ দিন মিডিয়া কাভারেজ পাচ্ছেন। এটা যথেষ্ট থেকেও অনেক অনেক বেশী। কারন ওদিকে যে মুক্তিযোদ্ধারা ৩৬৫ দিনে মাত্র ২দিন (ষোলই ডিসেম্বর ও ছাব্বিশ মার্চ) আর ভাষা সৈনিকরা মাত্র ১দিন (একুশে ফেব্রুয়ারী) মিডিয়ার নজরে পড়ছেন?

লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
ছড়াই লিখে যাব।

অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা?
(দীর্ঘশ্বাস)।

নবীনদের প্রতি আপনার পরার্মশ কি?
পরার্মশ দেওয়ার মত যোগ্যতা এখনো হয়নি। আরও বছর খানেক পরে যোগাযোগ করুন, ততদিনে কিছু যোগ্যতা হলে জানাব।

“বইওয়ালার” জন্য কিছু বলবেন?
অবশ্যই, দেশ দারুন- গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাইজেশনের এই মুগ্ধ যুগে আমরা সবাই যখন স্বপ্ন দেখছি দেশ একদিন লন্ডন-আমেরিকা নয় বরং সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা ‘ফার্মভিল’ হয়ে উঠবে, তখন বাংলাদেশী সাহিত্যের ওয়েব পোর্টাল বইওয়ালা ডট কম নিয়ে আমি দারুন আশাবাদী। আপনাদের পথ মসৃন ও পথচলা অবিরাম হোক।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।